হাসান বসরী রহ. বলেন
فَسَاد الْقُلُوبِ متولد مِنْ سِتَّةِ أشياء: يذنبون برجاء التوبة، ويتعلمون العلم ولا يعملون به، وإذا عملوا لا يخلصون، ويأكلون رزق الله ولا يشكرون، ولا يرضون بقسمة الله، ويدفنون موتاهم ولا يعتبرون
অন্তর ছয় কারণে নষ্ট হয়ে যায়
১. তাওবা করে নিবে এই আশায় গোনাহ করে।
২. ইলম শিখে তবে আমল করে না।
৩. আমল করে তবে ইখলাস থাকে না।
৪. আল্লাহর রিজিক আহরণ করে কিন্তু শোকর আদায় করে না।
৫. আল্লাহর বণ্টনে খুশি থাকে না।
৬. মৃতদেরকে দাফন করে কিন্তু এ থেকে উপদেশ গ্রহন করে না। (ইকাযু উলিল হিমামিল আলিয়া : ১৩২)
প্রথম কারণ : তাওবা করার আশায় গোনাহ করা
অনেকেই এই চিন্তা করে গোনাহ করতে থাকে যে, গোনাহ যতই করি না কেন, যেহেতু তাওবা করলে আল্লাহ মাফ করে দেন, সুতরাং গোনাহ করবো আর তাওবা করবো; এখন গোনাহের মজা লুটে নেই, পরে তাওবা করে নিবো; সমস্যা কোথায়?
মূলত এটি একটি ভয়াবহ চিন্তা। এজাতীয় চিন্তা স্বতন্ত্র একটি গোনাহ। এমন চিন্তা লালনকারীর উপর উপর আল্লাহর নারাযি ও গযব নেমে আসে; এমনকি তার তাওবা করাই নসিব হয় না।
হাকীমুল উম্মত শাহ আশরাফ আলী থানবী রহ বলেন, এটা আল্লাহ তাআলার রহমতের প্রতি আশা নয়; বরং তামাশা।
তিনি বলেন, নিয়ম হল, অতীত গোনাহের ব্যাপারে আল্লাহ তাআলার রহমতের প্রতি আশা রাখতে হয়। আর বর্তমান ও ভবিষ্যৎ গোনাহের ব্যাপারে রাখতে হয় আল্লাহর তাআলার আযাবের ভয়। যে লোক বর্তমান ও ভবিষ্যৎ গোনাহের ব্যাপারে আল্লাহর তাআলার আযাবের ভয় রাখার পরিবর্তে তাঁর রহমতের প্রতি আশা রাখে যে, যেহতু তাঁর কাছে ক্ষমা চাইলে ক্ষমা পাওয়া যাবে, তাই গুনাহ করে নেই; তাহলে এই লোক মূলত আল্লাহ তাআলার রহমতের প্রতি আশার বিষয়টিকে তামাশা বানিয়ে ফেলল।
বদ আমলের শিকার হয় কে?
একারণে হাসান বসরী রহ. বলতেন
مَا أَطَالَ عَبْدٌ الْأَمَلَ إِلَّا أَسَاءَ الْعَمَلَ
যে-ই কামনাকে দীর্ঘায়িত করেছে, সে-ই বদ আমলের শিকার হয়েছে। (ইবনু আবিদ্দুনয়া, ক্বাসরুল আমল : ১০২)
এসবই শয়তানের অতি সুক্ষ্ম কৌশল
শয়তান মানুষের বড় চালাক দুশমন। শয়তানের চক্রান্তের কোনো শেষ নেই। একবার সে চেষ্টা করে মানুষকে তাওবা থেকে দূরে রাখতে, আবার চেষ্টা করে তাওবার প্রতি অতি-ভরসার মাধ্যমে তাকে গোমরাহ করতে যে, গোনাহ করতে থাকো, চিন্তা কী, আল্লাহ তো তাওবা কবুলকারী, তাওবা করলেই মাফ করে দেবেন।
যে গায়রে মাহরামের সাথে কথা বলে, দেখা করে, বন্ধু ভাবে। সে এটা ভেবে নিজেকে অন্যদের চেয়ে ভাল মনে করে যে, অন্যদের মত সে প্রেম তো আর করছে না।
যে মেয়েটা প্রেম করে। সে এটা ভেবে নিজেকে অন্যদের থেকে ভাল ভাবে যে, প্রেম করলেও অন্যদের মত যিনা তো করেনি!
যে যিনা করে অভ্যস্ত। সে এটা ভেবে অন্যদের চেয়ে নিজেকে ভাল ভাবে যে, এবরশনের মত জঘন্য কাজ তো আর তাকে দিয়ে হয়নি!
এসবই শয়তানের কৌশল। শয়তান অতি সুক্ষ্মভাবে এই প্রক্রিয়াগুলো সম্পন্ন করে। সে একদিকে মানুষকে তাওবা থেকে দূরে রাখে। অপরদিকে তাওবার ভরসায় গোনাহের প্রতি পথ দেখায়। আবার অপরদিকে যে গোনাহগার তার চিন্তার সামনে তারচেয়েও ভয়ঙ্কর গোনাহে লিপ্ত কোনো বক্তিকে নিয়ে আসে, ফলে সে নিজেকে ওর চেয়ে ভাল মনে করে প্রফুল্ল হয় এবং তাওবার চিন্তা থেকে দূরে সরে যায়।
মুনাফিকের মানসিকতা
হাসান বসরী রহ. উক্ত মানসিকতাকে মুনাফিকের মানসিকতার সঙ্গে তুলনা করেছেন। তিনি বলেন
وَالْمُنَافِقُ يَقُولُ: سَوَادُ النَّاسِ كَثِيرٌ وَسَيُغْفَرُ لِي، وَلَا بَأْسَ عَلَيَّ، يَسِيئُ فِي الْعَمَلِ وَيَتَمَنَّى عَلَى اللَّهِ عَزَّ وَجَلَّ
মুনাফিক দ্বিধাহীন কণ্ঠে বলে বেড়ায়, আমার মত বহু লোক আছে। তারা ক্ষমা পেলে আমিও পেয়ে যাব। এত চিন্তা কিসের! এই মানসিকতার কারণে সে গুনাহ করে বেড়ায় আর আল্লাহর প্রতি অর্থহীন আশা মনের মাঝে লালন করে। (ইবনু আবিদ্দুনয়া, আযযুহদ : ১৯৬)
সঠিক মানসিকতা
সঠিক মানসিকতা তো এই যে, নিজের দিক থেকে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকবে গোনাহ থেকে বেঁচে থাকার। এরপরেও যদি গোনাহ হয়ে যায় তখন আল্লাহর রহমত থেকে নিরাশ না হয়ে সঙ্গে সঙ্গে লজ্জিত হয়ে তাওবা করে নেবে। পরে তাওবা করে নেবো এ ভরসায় গোনাহ করা কিংবা নিজের চেয়ে ভয়ঙ্কর কোনো গোনাহগারের সঙ্গে নিজেকে তুলনা করে মনে মনে আনন্দিত হওয়া এটা শয়তানের খুবই সূক্ষ্ম চাল।
হাসান বসরী রহ. বলেন
إن المؤمن، والله، ما تراه إلا يلوم نفسه على كل حالاته؛ يستقصرها فى كل ما يفعل فيندم ويلوم نفسه، وإن الفاجر ليمضى قدما لا يعاتب نفسه
আল্লাহর কসম! তুমি মুমিনকে সর্বাবস্থায় নিজের মনকে তিরস্কার করতে দেখতে পাবে। তার সব কাজেই সে কিছু না কিছু ত্রুটি খুঁজে পায়। তাই কেন এ ত্রুটি হলো তা ভেবে সে লজ্জিত ও অনুশোচিত হয় এবং মনকে সে জন্য তিরস্কার করে। পক্ষান্তরে পাপাচারী দুষ্কৃতিকারী অসংকোচে অন্যায়-অপকর্ম করে, তা নিয়ে মনকে সে কদাচিৎই ভৎর্সনা করে। (ইগাসাতুল লাহফান : ১/৭৭)
মুমিনের জন্য ঈদের দিন
তিনি আরো বলেন
كُلُّ يَوْمٍ لَا يُعْصَى اللهُ فِيهِ فَهُوَ عِيدٌ، فَالْيَوْمُ الَّذِي يَقْطَعُهُ الْمُؤْمِنُ فِي طَاعَةِ مَوْلَاهُ وَذِكْرِهِ وَشُكْرِهِ فَهُوَ لَهُ عِيدٌ
প্রত্যেক ওই দিন মুমিনের জন্য ঈদের দিন, যেদিন সে আল্লাহর অবাধ্য হয় না অর্থাৎ কোনো গুনাহ করে না। ওই দিনটি মুমিনের জন্য ঈদের দিন, যেদিনটি সে প্রভুর আনুগত্যে, তাঁর স্মরণে এবং তাঁর প্রতি শুকরিয়া আদায়ের মাধ্যমে অতিবাহিত করে। (ইবনু রজব, লাতায়েফুল মা‘আরেফ : ২৭৮)
মৃত্যু দ্রুত ধাবমান
তুমি যে তাওবার ভরসায় গোনাহে লিপ্ত হতে চলেছো, কী নিশ্চিয়তা আছে যে, তাওবার সুযোগ তুমি পাবে। কে জানে মৃত্যুর ফিরেশতা তখন থাবা দেয়ার জন্য তৈয়ার হয়ে আছেন কি না!
একবার হাসান বসরী রহ. এর ছেলে বাবার কাছে এসে বলল, আব্বাজান! তীরটা ভেঙ্গে গেছে।
তিনি বললেন, দেখি, কোনটা?
ছেলে দেখাল যে, এটা। তখন তিনি দেখে বললেন
الْأَمْرُ أَسْرَعُ مِنْ ذَلِكَ
মৃত্যু এর চেয়েও দ্রুত ধাবমান। (ইবনু আবিদ্দুনয়া, ক্বাসরুল আমল : ৩৮)
তাওবার চিন্তা যার আসে না
ধরে নিলাম, গোনাহ করার পর তৎক্ষণাৎ মৃত্যু এলো না, বরং তাওবার সুযোগ পাওয়া গেলো!
কিন্তু আল্লাহর বান্দা এরপরেও কথা আছে। মাশায়েখ বলেন, তাওবা করে নিবে এই চিন্তা করে যারা গোনাহ করে সাধারণত সারা জীবনেও তাদের তাওবার তাওফীক হয় না।
তাওবার আশাকে গোনাহ করার হাতিয়ার বানানোর কারণে এবং আল্লাহর রহমতের প্রতি অন্যায় আশা করার কারণে এমন লোক প্রকৃত তাওবা থেকে মাহরুম থেকে যায়। ফলে দীর্ঘ সময় ও সুযোগ পাওয়ার পরও তাওবা ছাড়াই মরতে হয়। গাফলত ও উদাসীনতা তাকে পেয়ে বসে। গোনাহের নেশা তাকে ধরে বসে। আল্লাহকে সে ভুলে বসে। এভাবে ধীরে ধীরে সে নফস ও শয়তানের গোলামে পরিণত হয়। তখন তাওবা করার কথা ভুলেও তার মনে পড়ে না।
আল্লাহ তাআলা বলেন
وَلا تَكُونُوا كَالَّذِينَ نَسُوا اللَّهَ فَأَنْسَاهُمْ أَنْفُسَهُمْ أُولَئِكَ هُمُ الْفَاسِقُونَ
আর তোমরা তাদের মত হয়ে না যারা আল্লাহকে ভুলে গেছে; ফলে আল্লাহও তাদেরকে করেছেন আত্মভোলা। এরাই তো ফাসিক। (সূরা হাশর : ১৯)
গোনাহ গোনাহকে টেনে
তাছাড়া গোনাহ গোনাহকে টেনে আনে। একজন মানুষ গোনাহ থেকে বেঁচে থাকলে তার মধ্যে আল্লাহর ভয় কাজ করে। একপ্রকার সংকোচবোধ কাজ করে। কিন্তু তাওবার করে নিবে এই আশায় যখন গোনাহ করা হয় তখন এই ভয় ও সংকোচ তার মধ্যে আর থাকে না। সে বেপরোয়া হয়ে ওঠে। ফলে একটা সময় তার রুচির বিকৃতি ঘটে। তখন নেক আমল ভালো লাগে না; গোনাহ ভাল লাগে। তখন তাওবার চিন্তা মাথা থেকে একেবারে উধাও হয়ে যায়।
সুতরাং তাওবা করে নিব এই আশায় গোনাহ করা বোকামি ছাড়া আর কিছু নয়। সাপ বড় হোক কিংবা ছোট; সতর্ক থাকতে হয়। অনুরূপভাবে ছোট্ট গোনাহটি থেকেও নিজেকে বাঁচিয়ে রাখতে হয়।
মুফতী মুহম্মদ শফী রহ.-এর একটি ঘটনা
বিষয়টি বোঝানোর জন্য মুফতী মুহম্মদ শফী রহ. নিজের জীবনের একটি ঘটনা বলেন। তিনি বলেন, আমরা যখন দেওবন্দে ছিলাম। একবার সেখানে বিচ্ছুর উপদ্রব দেখা দিল। লোকজন প্রায় আক্রান্ত হত। বিচ্ছুর বিষ নামানোর তদবীর আমার জানা ছিল। তাই আক্রান্ত লোকজন আমার কাছে প্রায় আসতো। দম করে দিতাম; ভালো হয়ে যেত।
একবারের ঘটনা। তখন বিদ্যুৎ ছিলো না। আমি চেরাগের আলোতে লেখাপড়া করতাম। আমার স্ত্রী তার কোনো প্রয়োজনে স্টোররূমে যাবে। তাই আমার কাছে একটু সময়ের জন্য চেরাগটা চাইল। কিন্তু আমি লেখাপড়ায় মগ্ন থাকার কারণে তাকে বললাম, সামান্য কাজ, চেরাগ ছাড়াই চলে যাও।
স্ত্রী বলল, যদি বিচ্ছু থাকে!
আমি হেসে উঠে বললাম, ভয়ের কী আছে, দম করে দেবো, ইনশাআল্লাহ ভালো হয়ে যাবে।
আল্লাহর কী ইচ্ছা, আমার স্ত্রীর আশঙ্কাই সত্য হলো, বিচ্ছু তাকে দংশন করলো।
আমি সঙ্গে সঙ্গে উঠে গেলাম এবং ঝাড়ফুঁক শুরু করলাম, যা দ্বারা ইতোপূর্বে বহু আক্রান্ত রোগী ভালো হয়েছিল। কিন্তু আজ কোনো কাজ হলো না। শেষ পর্যন্ত অন্য চিকিৎসা নিতে হলো এবং অনেক পেরেশানি পোহাতে হলো।
মুফতী মুহম্মদ শফী রহ. ছিলেন শায়খুল ইসলাম মুফতী তাকী উসমানী দা. বা.-এর বাবা। মুফতী তাকী উসমানী দা. বা. তাঁর বাবার এই ঘটনা তাঁর ইসলাহী খুতুবাতে অনেক বার বলেছেন।
তিনি বলেন, আব্বাজান আমাদেরকে এ ঘটনা শোনানোর পর বলতেন, দেখো, আমল ও তদবীরের ভরসায় আমি বিচ্ছু থেকে সতর্ক হইনি। আমি ভেবেছিলাম, দংশন যদি করেই তো কী হবে?! আমার কাছে তদবীর তো আছে! দম করবো, আর বিষ নেমে যাবে। কিন্তু কী হলো! বিষ নামলো না!
এর দ্বারা আল্লাহ তাআলা প্রথমত এ শিক্ষা দান করলেন যে, ওষুধ কিংবা চিকিৎসা, আমল কিংবা তদবীর; যতক্ষণ পর্যন্ত আল্লাহর হুকুম না হবে, কোনো কাজ হবে না । তাই দেখা যায়, এক ওষুধে এক রোগী ভালো হয়, অন্য রোগীর ক্ষতি হয়, অথচ দু’জনের রোগ একই।
ওষুধের ভরসায় রোগ ডেকে আনা
মুফতী তাকী উসমানী দা. বা. বলেন, আব্বাজান বলতেন, এ ঘটনার দ্বিতীয় শিক্ষা এই যে, তোমার কাছে যত উন্নত চিকিৎসা ও পরীক্ষিত তদবীরই থাকুক; এর ভরসায় রোগ ডেকে এনো না, বরং সকল রোগ-ব্যাধি থেকে আল্লাহর কাছে পানাহ চেয়ে দোয়া করো যে, হে আল্লাহ! রোগ-শোক বরদাশত করার শক্তি আমার নেই। সুতরাং সমস্ত রোগ-শোক থেকে আপনি আমাদের হিফাযত করুন।
এ ঘটনার তৃতীয় শিক্ষা এই যে, যেমনিভাবে ওষুধ-চিকিৎসা ও ঝাড়ফুঁক তদবীরের ভরসায় রোগ ডেকে আনা এবং বিচ্ছু থেকে সতর্ক না থাকা অতি বড় নির্বুদ্ধিতার কাজ। অনুরূপভাবে তাওবার দরজা খোলা আছে, এ ভরসায় গোনাহ করা এর চেয়ে বড় নির্বুদ্ধিতার কাজ।
কেননা, কে জানে, গোনাহ করার পর তাওবা করার সুযোগ হবে কি না! তাওবা করার সুযোগ হয়ও যদি, তা কবুল হবে কি না!
যাই হোক, এজন্যই হাসান বসরী রহ. বলতেন, অন্তর নাপাক হওয়ার একটা কারণ হল, তাওবা করে নিবে এই আশায় গুনাহ করা।
দ্বিতীয় কারণ : ইলম অনুযায়ী আমল না করা
অন্তর নাপাক হওয়ার দ্বিতীয় কারণ হল, ইলম শিখে আমল না করা। যা জানে, তার উপর আমল না করা।
হাদীসে এসেছে, কেয়ামতের দিন আল্লাহ তাআলা প্রত্যেক বান্দাকে জিজ্ঞেস করবেন
مَاذَا عَمِلَ فِيمَا عَلِمَ ؟
ইলম অনুযায়ী আমল করেছে কি? (তিরমিযী : ২৪১৬)
অর্থাৎ, ইসলাম সম্পর্কে যে জ্ঞানটুকু তোমার ছিল, সে অনুযায়ী আমল করেছে কিনা? তুমি মেনে চলেছ কিনা?
যেমন নামায ফরয, রোজা ফরয, সম্পদশালীর জন্য যাকাত ও হজ্জ ফরয। সত্যবাদিতা, আমানতদারিতা ফরয। সুদ ঘুষ দুর্নীতি অহংকার হিংসা লোভ কুদৃষ্টি হারাম। এগুলো কোন্ মুসলমান না জানে! কিন্তু অন্তর নাপাক হওয়ার কারণে আমল করতে পারে না।
জানার পরেও না মানার কারণ
এভাবে একে তো আমরা যতটুকু জানি, তা মেনে চলি না। উপরন্তু নিজের কামনা-বাসনা চরিতার্থ করার জন্য অনেক সময় এমন আচরণ দেখিয়ে থাকি যে, ঈমান চলে যাওয়ার আশংকা সৃষ্টি হয়।
যেমন বর্তমানে প্রেমিক-প্রেমিকাদের কমন প্রশ্ন। ইসলামে কোথায় বলা আছে প্রেম নিষেধ? কোথায় আছে প্রেম হারাম?
অথচ এরা কিন্তু জানে, ইসলামে পরনারীর প্রতি কুদৃষ্টি দেয়া হারাম, নারীর জন্য পর্দা করা ফরয। পরনারী ও পরপুরুষের নির্জনবাস হারাম। কিন্তু মানতে পারে না। কারণ, অন্তর নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
ঘুষখোর, সুদখোরের সামনে ঘুষ সুদের বয়ান করলে সে বলে উঠে হুজুর, আমাদের পেটে লাথি মারবেন না। সে কেন একথা বলে? সে কি জানে না, সুদ ঘুষ হারাম? সে কি জানেনা রিযিকদাতা একমাত্র আল্লাহ? জানে। কিন্তু মানবে না। কারণ, অন্তর নষ্ট হয়ে গিয়েছে।
আমলবিহীন আলেম ও দাঈর পরিণতি
এই তো গেলো সাধারণ মানুষের কথা। আর আমলবিহীন আলেম ও দাঈদের বিষয়ে শুধু একটি হাদীস পেশ করছি। রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন, এক ব্যক্তিকে কেয়ামতের দিন নিয়ে আসা হবে। তার পর তাকে জাহান্নামে নিক্ষেপ করা হবে। এতে তার নাড়িভুঁড়ি বের হয়ে যাবে। আর সে তা নিয়ে ঘুরতে থাকবে যেমনভাবে গাধা আটা পিষা জাঁতার সাথে ঘুরতে থাকে। জাহান্নামিরা তার কাছে একত্রিত হয়ে তাকে জিজ্ঞেস করবে
أَيْ فُلاَنُ مَا شَأْنُكَ أَلَيْسَ كُنْتَ تَأْمُرُنَا بِالْمَعْرُوفِ وَتَنْهَانَا عَنْ الْمُنْكَرِ
হে অমুক সাহেব! আপনি কি আমাদের ভালো কাজের আদেশ এবং মন্দ কাজের নিষেধ করতেন না?
সে বলবে
كُنْتُ آمُرُكُمْ بِالْمَعْرُوفِ وَلاَ آتِيهِ وَأَنْهَاكُمْ عَنْ الْمُنْكَرِ وَآتِيهِ
হ্যাঁ। আমি তোমাদের ভালো কাজের আদেশ করতাম, কিন্তু নিজে করতাম না। আর খারাপ কাজের নিষেধ করতাম কিন্তু নিজেই তা করতাম। (বুখারী : ৩২৬৭)
আল্লাহ আমাদেরকে হেফাজত করুন আমীন।
মানুষকে তোমার কর্ম দ্বারা উপদেশ দাও
এজন্য হাসান বসরী রহ. বলতেন
عِظِ النَّاسَ بِفِعْلِكَ وَلاَ تَعِظْهُمْ بِقَوْلِكَ
মানুষকে তোমার কর্ম দ্বারা উপদেশ দাও। কেবল তোমার কথার মাধ্যমে উপদেশ দিয়ো না। (আয-যুহদ : ২২২)
তৃতীয় কারণ : আমলে ইখলাস না থাকা
অন্তর নাপাক হওয়ার তৃতীয় কারণ হল, আমলে ইখলাস না থাকা।
আমলের মূলপ্রাণ ইখলাস। যে আমলে ইখলাস নেই সে আমল প্রাণহীন দেহের মত। প্রাণহীন দেহকে বলা হয় লাশ। মানে ‘লা শাই’ ; কোনো মূল্য নেই। সে নড়তে পারে না, চলতে পারে না। কথা বলতে পারে না। কেউ তাকে আক্রমণ করলে প্রতিহত করে পারে না। ইখলাসবিহীন আমলও তেমন। এই আমল যত বড় বা বেশি হোক না কেন; আখেরাতে কোনো কাজে আসবে না।
ইবনুল ক্বাইয়িম রহ. বলেন
العملُ بغير إخلاص ولا اقتداءٍ كالمسافر يَملأُ جرابَهُ رملًا يُثْقِلُهُ ولا ينفعُهُ
ইখলাস ও রাসূলুল্লাহ ﷺ-এর আনুগত্যবিহীন আমল হচ্ছে সেই মুসাফিরের মতো যে তার থলে বালু দিয়ে ভর্তি করে। আর সেই বালু তার থলে ভারী করলেও তার কোনো উপকার করতে পারে না। (আল-ফাওয়ায়েদ : ১/৬৬)
নফসের উপর যে জিনিস সবচেয়ে ভারী
সাহল তাশতারী রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল
أَيُّ شَيْءٍ أَشَدُّ عَلَى النَّفْسِ؟
নফসের উপর কোন জিনিসটা সবচেয়ে বড় ভারী?
তিনি বললেন
الْإِخْلَاصُ؛ لِأَنَّهُ لَيْسَ لَهَا فِيْهِ نَصِيْبٌ
ইখলাস। কেননা এতে নফসের কোনোই অংশ নেই। (মাদারিজুস সালিকীন : ২/৯২)
বর্তমানে ওয়ায়েজ এবং দাঈদের কথায় কাজ কম হয় কেন?
বর্তমানে বক্তা-ওয়ায়েজ-মুফাসসির-দাঈর অভাব নেই। তিক্ত বাস্তবতা হল, এরপরেও মানুষের মাঝে কোনো পরিবর্তন নেই। এর অন্যতম কারণ হল, ইখলাসহীনতা।
ইমাম আহমদ ইবনু হাম্বল রহ.-এর ছেলে ইমাম হামদুন রহ.-কে জিজ্ঞেস করা হয়েছিল, আমাদের কথার চেয়ে সালাফদের কথা বেশি উপকারী ছিল। এর কারণ কী?
তিনি উত্তর দেন
لأنهم تكلموا لعز الإسلام ونجاة النفوس ورضاء الرحمن ، ونحن نتكلم لعز النفس وطلب الدنيا وقبول الخلق
কারণ, তারা কথা বলতেন ইসলামের মর্যাদা রক্ষার জন্য, নিজেদের নাজাতের জন্য এবং আল্লাহর সন্তুষ্টি অর্জনের জন্য। আর আমরা কথা বলি, নিজেদের সম্মান বাড়ানোর জন্য, দুনিয়া কামানোর জন্য এবং মানুষের কাছে প্রিয় হওয়ার জন্য। (হিলয়াতুল আউলিয়া : ১০/২৩১)
আমাদের ইখলাসহীনতার কিছু দৃষ্টান্ত
মনে করুন, এক লোক হজ্জ করেছেন তিন বার। আরেকজন তার বাসায় বেড়ানোর জন্য গিয়েছেন। তার জায়নামাযের প্রয়োজন দেখা দিয়েছে। এবার মেজবান বলে ওঠল, তৃতীয়বার হজ্জে গিয়ে যে জায়নামাযটা এনেছি, ওটা এনে দাও তো! অর্থাৎ, তিনি বুঝিয়ে দিলেন যে, তিনি হজ্জ করছেন একবার কিংবা দুই বার নয়; বরং তিন বার।
আমার জন্য দোয়া করবেন, আমিও আপনার জন্য তাহাজ্জুদ পড়ে দোয়া করব। অর্থাৎ, আমি বুঝিয়ে দিলাম যে, আমি তাহাজ্জুদগুজার!
দাওয়াত ও তাবলীগের সফরে দু’ একটি দেশ ঘোরার তাওফীক আল্লাহ আপনাকে দিয়েছেন। আপনি কারো সঙ্গে অন্য বিষয়ে কথা বলছেন। ফাঁকে হঠাৎ বলে উঠলেন, আমাদের দেশে নিয়ম বলতে কিছু নেই। অমুক দেশে দেখে এসেছি, কত সুন্দর নিয়ম। অর্থাৎ, আপনি বুঝিয়ে দিলেন যে, আপনি বিদেশ সফর করেছেন।
কয়েকজন মিলে আলাপ করছে। আলাপের ফাঁকে একজন অন্যজনকে উদ্দেশ্য করে বলল, বন্ধু তোমার কী মনে আছে আরাফার ময়দানের ওই ঘটনাটা? এর পর বিস্তারিত ঘটনার বিবরণ। এইখানেও ওই বিবরণটা বন্ধুদের আলাপের মাঝে টেনে আনার উদ্দেশ্য হলো, তার হজ কিংবা উমরার বিষয়টি জানান দেওয়া।
সোশ্যাল মিডিয়া আমল কবুলের অন্তরায়
দুঃখের বিষয়, বর্তমানে সোশ্যাল মিডিয়া আমল কবুলের পথে সবচেয়ে বড় অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। ইবাদত-বন্দেগিতেও সেলফির অনুপ্রবেশ ঘটে গিয়েছে এবং আমল ধ্বংসে মারাত্মকভাবে ভূমিকা রাখছে। এমনকি পবিত্র হজ্জ পালন করতে গিয়ে আল্লাহর ঘরের সামনেও সেলফি তোলা হচ্ছে। নামাজের মতো অঙ্গভঙ্গি করে কিংবা জুমার নামাজ পড়তে গিয়ে মসজিদে বসে সেলফি তোলেন কেউ কেউ!
অনেকে আবার ফেসবুকে পোস্ট দেন, আলহামদুলিল্লাহ, আগামী অমুক তারিখ উমরার অনুমতি পেয়েছি।
ফজরে নামায পড়তে উঠেছেন, কেউ জানলো না। তাই সেটা মানুষকে জানানোর জন্য দিলেন ফেসবুকে একটা পোস্ট— সবাই নামাজ পড়তে উঠুন।
কোরবানির জন্য গরু কিনেছেন। তারপর পশুর একটা ফটো তুলে দিলেন ফেসবুকে পোস্ট, নীচের ক্যাপশনে লিখে দিলেন, আলহামদুলিল্লাহ! আল্লাহ তুমি কবুল করো।
এই যে চিত্রগুলো তুলে ধরলাম, হয়ত এই মজলিসের অনেকের জীবনের সঙ্গে তা মিলে যাচ্ছে।
তাহলে বলুন, আমল করার পর আপনি যে এভাবে নানা রকম করে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে প্রচার করলেন, এটা কি রিয়া বা লোক দেখানো হয়ে গেল না? কখনও ভেবে দেখেছেন, এসব অর্থহীন লৌকিকতা আপনার কষ্টের আমলগুলোকে নষ্ট করে দিচ্ছে!
আল্লাহ তাআলার মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার নিদর্শন
হাসান বসরী রহ. বলেন
مِنْ عَلاَمَةِ إعْرَاضِ اللهِ عَنِ الْعَبْدِ أَنْ يَجْعَلَ شُغْلَهُ فِيمَا لاَ يَعْنِيهِ
কোনো বান্দা থেকে আল্লাহর মুখ ফিরিয়ে নেওয়ার নিদর্শন হল, অনর্থক কাজ—কর্মে তাকে ব্যস্ত করে দেওয়া। (জামেঊল ঊলূম ওয়াল হিকাম : ১/২৯৪)
হাসান বসরী রহ.-এর মজলিস
একবার হাসান বসরী রহ.-এর মজলিসে এক লোক তাঁর নসিহত শুনে হঠাৎ চিৎকার করে উঠল। তখন হাসান বসরী রহ. তাকে বললেন, আল্লাহর কসম, আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন তোমাকে এ চিৎকার সম্পর্কে জিজ্ঞেস করবেন, এর দ্বারা তোমার উদ্দেশ্য কী ছিল। (কিতাবুয যুহুদ, আব্দুল্লাহ ইবনুল মুবারক : ২১৯)
লোক দেখানো আমলের পরিণতি
হাদীসে এসেছে, রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেছেন
أخْوَفَ ما أخافُ عليكم الشِّركُ الأصْغَرُ، قالوا: قال: الرِّياءُ؛
আমি তোমাদের উপর আমি সর্বাপেক্ষা ভয় করছি ছোট শিরক সম্পর্কে।
সাহাবায়ে কেরাম এটা শুনে ভয় পেয়ে গেলেন। তাই তাঁরা রাসূলুল্লাহ ﷺ-কে জিজ্ঞেস করলেন
وما الشِّركُ الأصْغَرُ يا رسولَ اللهِ؟
হে আল্লাহর রাসূল! ছোট শিরক কী?
রাসূলুল্লাহ ﷺ উত্তর দিলেন
তা হল রিয়া তথা লোক দেখানো কর্ম বা ইবাদত।
তারপর তিনি বলেন
يقولُ اللهُ عزَّ وجلَّ لهم يومَ القِيامةِ إذا جُزِيَ الناسُ بأعمالِهم: اذْهَبوا إلى الذين كنتُم تُراؤون في الدُّنيا، فانظُروا هل تَجِدون عِندَهُم جزاءً؟
আল্লাহ তাআলা কেয়ামতের দিন যখন লোকেদের আমলসমূহের বদলা দান করবেন তখন এদের উদ্দেশ্যে বলবেন, তোমরা তাদের নিকট যাও, যাদেরকে প্রদর্শন করে দুনিয়াতে তোমরা আমল করেছিলে। দেখ, তাদের নিকট কোন প্রতিদান পাও কি না! (মুসনাদে আহমাদ : ২৩৬৩০)
চতুর্থ কারণ : শোকর আদায় না করা
অন্তর নষ্ট হওয়ার চতুর্থ কারণ হল, আল্লাহর রিজিক ভোগ করে শোকর আদায় না করা।
রিজিক শুধু খাবার বা টাকা নয়। আপনার একজন মুখলিস হিতাকাঙ্ক্ষী থাকা এটাও রিজিকের একটি রূপ। হৃদয়ের শান্তি এবং একটি সুখী পরিবার এই সব-ই রিজিকের একটি অংশ।
ওলামায়ে কেরাম বলেন, রিজিকের সর্বনিম্ন স্তর হল, আর্থিক সচ্ছলতা। সর্বোচ্চ স্তর হল, শারীরিক ও মানসিক সুস্থতা। সর্বোত্তম স্তর হল, পুণ্যবান স্ত্রী ও পরিশুদ্ধ নেক সন্তান। পরিপূর্ণ স্তর হল, মহান আল্লাহর সন্তুষ্টি।
কখনো ভেবে দেখেছেন কি?
জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত একজন মানুষ আল্লাহ তাআলার কী পরিমাণ নেয়ামত ভোগ করে তা সত্যিই কল্পনাতীত। কখনো কি ভেবে দেখেছেন যে, আল্লাহ এই মস্তিস্ক সুস্থ না রাখলে পাগল হতাম, চোখ না দিলে অন্ধ হতাম, কান ঠিক না রাখলে বধির হতাম, যবান না দিলে বোবা হতাম, হাত-পা না দিলে প্রতিবন্ধী হতাম, সন্তান না দিলে নিঃসন্তান হতাম, টাকা-পয়সা না দিলে ফকির হতাম, ইজ্জত না দিলে লাঞ্ছিত হতাম, ঈমান না দিলে বে-ঈমান হতাম, শেষ ও শ্রেষ্ঠ নবীর উম্মত না বানালে না-জানি কোন নবীর উম্মত হতাম!
মোট কথা, একজন মানুষ পানির ভিতর দুব দিয়ে থাকলে যেমনিভাবে তার চারিদিকে পানি থাকে, অনুরূপভাবে আল্লাহ তাআলা আমাদেরকে তাঁর অসংখ্য নেয়ামতের মাঝে ডুবিয়ে রেখেছেন। অথচ এই নেয়ামতগুলোর কোনো একটির জন্যও তাঁর কাছে কোনো দরখাস্ত করি নি। তিনি বিনা দরখাস্তে এক সব আমাদেরকে দান করেছেন! আলাহামদুলিল্লাহ।
বেশির ভাগ নেয়ামত সম্পর্কে আমরা অবগত নই
এক রাতে হাসান বসরী রহ. দাঁড়ান এবং নামায শুরু করেন। নামাযের মধ্যে সকাল পর্যন্ত এই আয়াত বিরামহীনভাবে তেলাওয়াত করতে থাকেন
وَإِن تَعُدُّواْ نِعْمَةَ اللّهِ لاَ تُحْصُوهَا إِنَّ اللّهَ لَغَفُورٌ رَّحِيمٌ
আর যদি তোমরা আল্লাহর নিআমত গণনা কর, তবে তার সংখ্যা নির্ণয় করতে পারবে না। নিশ্চয় আল্লাহ ক্ষমাশীল, পরম দয়ালু। (সূরা আননাহল : ১৮)
জিজ্ঞেস করা হল, মাত্র একটি আয়াত পড়ে সারা রাত শেষ করে দিলেন, কারণ কী?
তিনি উত্তর দেন
إن فيها معتبرا ما نرفع طرفا ولا نرده إلا وقع على نعمة وما لا نعلمه من نعم الله أكثر
আয়াতটিতে শিক্ষণীয় বিষয় আছে। আমরা দৃষ্টি যে দিকেই ঘুরাবো, আল্লাহ তাআলার নেয়ামত পাবো। বেশির ভাগ নেয়ামত তো আমাদের জানার বাইরেই আছে। (মাফাতিহু তাদাব্বুরিল কুরআন : ১/৪৬)
ঠাণ্ডা পানি এক মহান নেয়ামত
এক ব্যক্তি হাসান বসরী রহ.-এর নিকট এসে বলল, আমার এক প্রতিবেশী আছে, যে ফালুদা (الفالوذج) খায় না।
তিনি বললেন, কেন?
সে বলল, তার ধারণা যে, সে ফালুদার শোকর আদায় করতে পারবে না, তাই খায় না।
হাসান বসরী রহ. বললেন, সে কি ঠান্ডা পানি পান করে?
লোকটি বলল, হ্যাঁ।
তিনি বললেন, তোমার প্রতিবেশি নিশ্চয়ই একজন মূর্খ। কেননা আল্লাহ তাআলা তো ফালুদার তুলনায় ঠাণ্ডা পানির মাধ্যমে তার উপর আরো বেশি নেয়ামত বর্ষণ করছেন। (তাফসীরে কুরতুবী : ৬/২৪৩)
আমাদের দেহে লক্ষ লক্ষ দিরহামের সম্পদ আছে
এক ব্যক্তি তাবিঈ ইউনুস ইবন উবায়েদ এর কাছে এসে তার অভাব-অনটনের অভিযোগ করল। তখন ইবনু উবায়েদ রহ. তাকে বললেন, তুমি যে চোখ দিয়ে দেখতে পাও, এমন একটি চোখের বিনিময়ে যদি তোমাকে এক লক্ষ দিরহাম দেওয়া হয়, তুমি কি তাতে আনন্দিত হবে?
সে বলল, না।
তিনি বললেন, তোমার এক হাতের বিনিময়ে যদি তোমাকে এক লক্ষ দিরহাম দেওয়া হয়, তাতে কি খুশি হবে?
সে বলল, না।
তিনি বললেন, যদি তোমার দুই পায়ের বিনিময়ে এটা দেওয়া হয়?
সে বলল, না।
তখন ইউনুস রহ. তার প্রতি আল্লাহর এই নেয়ামতগুলো স্মরণ করিয়ে দিয়ে বললেন, আমি তো দেখতে পাচ্ছি তোমার কাছে লক্ষ লক্ষ দিরহামের সম্পদ আছে, অথচ তুমি দারিদে্র্যর অভিযোগ করছ। (সিয়ারু আ‘লামিন নুবালা : ৬/২৯২)
শোকর আদায় করবো কীভাবে?
তো কথা চলছিল, হাসান বসরী রহ. বলেন, অন্তর নষ্ট হওয়ার একটা আলামত হল, আল্লাহর দেয়া নেয়ামতের শোকর আদায় না করা। প্রশ্ন হল, শোকর আদায় করবো কীভাবে?
শোকর আদায়ের মৌলিক পদ্ধতি তিনটি। যথা
১. যবানের মাধ্যমে শোকর। যেমন মুখে আলহামদুলিল্লাহ বলা।
২. অন্তরের মাধ্যমে শোকর। অর্থাৎ, অন্তর আল্লাহ তাআলার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকা। তিনি আমাকে বিনা দরখাস্তে নেয়ামত দান করেন। অন্যথায় আমি তো তাঁর কাছে পাওনা ছিলাম না। তিনি মেহরবানী করে আমাকে দান করেছেন।
৩. আমলের মাধ্যমে শোকর। অর্থাৎ, আল্লাহর দেয়া নেয়ামতের সঠিক ব্যবহার করা। যদি অপব্যবহার হয় তাহলে না-শোকরি হবে। সঠিক ব্যবহার হলে শোকর আদায় হবে। যেমন, যদি চোখের গোনাহ করি, তবে চোখের নেয়ামতের না-শোকরি হবে। যদি গান শুনি, তবে কানের নেয়ামতের না-শোকরি হবে।
জুনায়েদ বাগদাদী রহ.
জুনায়েদ বাগদাদী রহ.। জগদ্বিখ্যাত সূফি মনীষী হযরত সাররী সাকতী রহ. ছিলেন তাঁর মামা। ছোটবেলা থেকেই তিনি মামার সযত্নসান্নিধ্য পেয়েছেন। ফলে আধ্যাত্মিক জ্ঞানে অনেকটা পথ এগিয়ে গেছেন শৈশবেই।
একবারের ঘটনা। তিনি বলেন, আমার বয়স তখন সাত বছর। মামা সাররী সাকতীর সামনে খেলছিলাম। তাঁর পাশে তখন কয়েকজন মানুষ। তারা কথা বলছিল শোকর প্রসঙ্গে। মামা সেখানে আমাকে ডাকলেন। জিজ্ঞেস করলেন, শোকর কাকে বলে?
আমি বললাম, আল্লাহর কোনো নেয়ামতকে তাঁর নাফরমানিতে ব্যবহার না করা।
উত্তর শুনে মামা বললেন, আমার ভয় হচ্ছে, এই আশ্চর্য প্রজ্ঞা-প্রতিভা তোমাকে না আবার কোনো পরীক্ষায় ফেলে দেয়।
হযরত জুনায়েদ বলেন, মামার এই মন্তব্যে সেদিন আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়েছিলাম। (সিফাতুস সাফওয়া : ২/২৫১—২৫২)
পঞ্চম কারণ : আল্লাহর বণ্টনে খুশি না থাকা
অন্তর নষ্ট হওয়ার পঞ্চম কারণ হল, আল্লাহর বণ্টনে খুশি না থাকা।
কেন আমার সাথেই এমন হয়? আল্লাহ কেন আমার এত পরীক্ষা নেন? আল্লাহ কেন আমাকে এতো কষ্টের জীবন দিলেন? আমাকে মেয়ে বানালেন কেন? আমাকে কালো বানালেন কেন? আমি খাটো কেন, লম্বা নয় কেন? আমার কপালে এরকম পাষাণ স্বামী বা উচ্ছৃঙ্খল স্ত্রী পড়ল কেন? আমার ভাগ্যে এরকম দাজ্জাল-শাশুড়ি জুটল কেন? আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামায পড়ি, কোনোদিন ঘুষ খাইনি, কিন্তু তারপরেও আমার এত বিপদ কেন?
আজকাল এজাতীয় প্রশ্ন শুধু অমুসলিম কিংবা নাস্তিকরা করে করে তা নয়; অনেক মুসলিমও এ প্রশ্নগুলো করে। এটা মূলত আল্লাহর তাআলার বণ্টনে খুশি না থাকার প্রমাণ। এর কারণে এদের অন্তর কলুষিত ও নোংরা হয়ে যায়।
এদের মূল সমস্যা
এজাতীয় লোকের সমস্যা হচ্ছে এরা মনে করে, যোগ্যতা থাকুক বা না থাকুক; আল্লাহ এদের জীবনটা ঠিকই আরামে পার করে যাবার সব ব্যবস্থা করে দিবেন। এরা আল্লাহর হুকুম মেনে চলুক বা না চলুক; এদের জীবনে কোনো সমস্যা থাকতে পারবে না।
পানিতে নামলে শরীর ভিজে যাবে, রোদে গেলে শরীর থেকে ঘাম বের হবে, আগুনে হাত দিলে পুড়ে যাবে; এরা এগুলো বিশ্বাস করে, কিন্তু গোনাহে ডুবে গেলে জীবনে অশান্তি নেমে আসবে এরা এটা বিশ্বাস করতে চায়না।
এরা চায় আল্লাহ মহাবিশ্বের সব নিয়ম কানুন ভেঙ্গে সব খারাপ কাজের প্রভাব থেকে এদেরকে মুক্ত রাখবেন। ফরমালিন খাবে কিন্তু আল্লাহ তাকে সুস্থ রাখতে হবে। বিষ খাবে কিন্তু আল্লাহ তাকে বিষক্রিয়ার প্রভাব দিতে পারবেন না।
আল্লাহ তো বলেই দিয়েছেন
وَمَا أَصَابَكُم مِّن مُّصِيبَةٍ فَبِمَا كَسَبَتْ أَيْدِيكُمْ وَيَعْفُو عَن كَثِيرٍ
তোমাদের যে বিপদ-আপদ ঘটে তাতো তোমাদেরই কৃতকর্মের ফল এবং তোমাদের অনেক অপরাধ তিনি ক্ষমা করে দেন। (সূরা শূরা : ৩০)
তিনি আরো জানাচ্ছেন
مَا یَفۡعَلُ اللّٰهُ بِعَذَابِکُمۡ اِنۡ شَکَرۡتُمۡ وَ اٰمَنۡتُمۡ
তোমরা যদি শোকরগুজারি কর আর ঈমান আন, তবে তোমাদেরকে শাস্তি দিয়ে আল্লাহর কী লাভ?
(সূরা নিসা: ১৪৭)
إِنَّ اللَّهَ لَا يَظْلِمُ النَّاسَ شَيْئًا وَلَٰكِنَّ النَّاسَ أَنفُسَهُمْ يَظْلِمُونَ
নিশ্চয়ই আল্লাহ মানুষের প্রতি কোনো জুলুম করেন না, মানুষই নিজেদের প্রতি জুলুম করে থাকে। (সূরা ইউনুস : ৪৪)
جب میں کہتا ہوں کہ یا اللہ میرا حال دیکھ
حکم ہوتا ہے کہ اپنا نامۂ اعمال دیکھ
যখন আমি বলি, হে আল্লাহ আমার অবস্থা দেখুন,
তখন যেন হুকুম আসে, তুমি আগে নিজের আমলনামা দেখ।
তাছাড়া পৃথিবীতে আমরা এসেছি পরীক্ষা দিতে—এটা হচ্ছে জীবনের সবচেয়ে বড় বাস্তবতা। আল্লাহ বলেন
أَحَسِبَ النَّاسُ أَنْ يُتْرَكُوا أَنْ يَقُولُوا آمَنَّا وَهُمْ لَا يُفْتَنُونَ
মানুষ কি মনে করে যে, তারা একথা বলেই অব্যাহতি পেয়ে যাবে যে, আমরা বিশ্বাস করি এবং তাদেরকে পরীক্ষা করা হবে না? (সূরা আল আনকাবুত : ২)
দুনিয়াবি কষ্টগুলো এক ধরনের পরীক্ষা। আল্লাহ কখনো সুখ-শান্তি দিয়ে পরীক্ষা করেন আবার কখনো রোগব্যাধি দিয়ে পরীক্ষা করেন। আল্লাহ বলেন
وَنَبْلُوكُمْ بِالشَّرِّ وَالْخَيْرِ فِتْنَةً
আমি তোমাদেরকে ভাল ও মন্দ উভয় অবস্থায় ফেলে এর দ্বারা পরীক্ষা করি। (সূরা আম্বিয়া : ৩৫)
সুতরাং আমাদের কখনোই নিরাশ হওয়া বা ধৈর্য হারানো উচিত নয়। কেন আমার নেই, কিন্তু ওর আছে, কেন আমারই বেলায় এরকম হয়, অন্যের কেন এরকম হয় না; এই সব অসুস্থ প্রশ্ন করে ঈমান নষ্ট করা যাবে না। কারণ আমরা জানি যে, আমরা পরীক্ষার মধ্য দিয়ে যাব এবং পরীক্ষায় আমাদের উত্তীর্ণ হতে হবে।
রাসূলুল্লাহ ﷺ বলেন
عَجَبًا لأَمْرِ الْمُؤْمِنِ إِنَّ أَمْرَهُ كُلَّهُ خَيْرٌ وَلَيْسَ ذَاكَ لأَحَدٍ إِلاَّ لِلْمُؤْمِنِ إِنْ أَصَابَتْهُ سَرَّاءُ شَكَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ وَإِنْ أَصَابَتْهُ ضَرَّاءُ صَبَرَ فَكَانَ خَيْرًا لَهُ
মুমিনের বিষয়টি কতইনা চমৎকার! তার জন্য কল্যাণ ছাড়া আর কিছুই নেই। তার জন্য যদি কোনো খুশির ব্যাপার হয় এবং সে কৃতজ্ঞতা আদায় করে তাহলে সেটি তার জন্য কল্যাণকর। আর যদি কোনো দুঃখের বিষয় হয় এবং সে ধৈর্য ধারণ করে, সেটিও তার জন্য কল্যাণকর। (মুসলিম: ২৯৯৯)
মুসিবতে তিন নেয়ামত
শুরাইহ রহ. বলেন
ما أصيب عبد بمصيبة إلا كان لله عليه فيها ثلث نعم إلا يكون في دينه وأن لا تكون أعظم مما كانت وأنها لا بد كائنة فقد كانت
যে কোনো বান্দাকে একটি মুসিবত স্পর্শ করলে আল্লাহর পক্ষ থেকে তাতে তার জন্য তিনটি নেয়ামত অবশ্যই থাকে
১. মুসিবতটা তার দীন সংক্রান্ত নয়
২. যে মুসিবত চেপেছে তার থেকেও বড় মুসিবত চাপতে পারত, কিন্তু তা চাপে নি।
৩. মুসিবতটা অবশ্যই হওয়ার কথা ছিল এবং তা হয়ে গেছে। (ইবনু আসাকির, তারীখু দিমাশক : ২৩/৪২)
ষষ্ঠ কারণ : মৃতদের দাফন দেখে উপদেশ গ্রহণ না করা
মানুষের জন্য বেঁচে থাকাটা অস্বাভাবিক কিন্তু মৃত্যুটা খুবই স্বাভাবিক। পৃথিবীর রঙ-রসে মেতে মৃত্যুকে হয়তো ভুলে থাকা যায়, কিন্তু মৃত্যুকে এড়ানো বা মৃত্যু থেকে পালিয়ে বাঁচা যায় না। যে জন্মেছে সে মরবেই। যার সূচনা হয়েছে তার সমাপ্তি ঘটবেই। এব্যাপারে বিজ্ঞানচর্চা কিংবা গবেষণার প্রয়োজন নেই। পৃথিবীর প্রথম মানুষ থেকে শুরু করে নির্ধারিত জীবনযাপনের পর কেউ আর বেঁচে নেই। এ জন্য পৃথিবীতে মানুষের চেয়ে কবরের সংখ্যা বেশি।
ভেবে দেখেছেন কি?
কিন্তু ভেবে দেখেছেন কি কখনো, মৃত্যুর সাথে সাথেই আমাদের নাম হয়ে যায় ‘লাশ’? লোকে বলবে ‘লাশের’ পা টা একটু সোজা করেন। লাশের মুখটা একটু দেখান। লাশের মুখটা ঢেকে দেন। ‘লাশ’কে কবরে নেয়ার সময় হয়েছে।
তখন কেউ আর আমার ডাক নাম ধরে ডাকবে না, ডাকবে না ম্যাডাম বা স্যার বলেও, বলবে শুধুই একটা লাশ। অনেকে রাতে ভয় পাবে বলে চেহারাটাও দেখবে না।
ভেবে দেখুন, সেই দিনটি কতইনা কষ্টের হবে। যখন আপনার আপনজনই আপনার লাশ কাঁধে নিয়ে আপন ঘর থেকে আপনাকে বের করে দিয়ে বাড়ীর পাশে অন্ধকার একটা জায়গার দিকে নিয়ে যাবে। যেই জায়গার পাশ দিয়ে আপনি হয়তো অসংখ্য বার আপনার বন্ধু-বান্ধব নিয়ে হাসতে হাসতে পথ চলেছিলেন। সেই দিনটিতে আপনি সবই দেখতে পাবেন, শুনতে পাবেন কিন্তু কিছুই বলতে পারবেন না। কতই না অসহায়ত্বপূর্ণ হবে আমাদের সেই দিনগুলো!
ওমর রাযি.-এর বিখ্যাত বাণী
كل يوم يقال : مات فلان وفلان، ولا بد من يوم يقال : مات عمر
প্রতিদিন ঘোষণা হয়, অমুক মারা গেছে, অমুকের ইন্তেকাল হয়েছে। একটি দিন তো অবধারিত, যেদিন বলা হবে, ওমরের মৃত্যু হয়েছে।
কবরে উঁকি মেরে দেখা
হাসান বসরী রহ. যখন কোনো জানাযা পড়াতেন, তখন কবরের মধ্যে উঁকি মেরে জোরে জোরে বলতেন, কত বড়ই না উপদেশদাতা সে। যদি জীবিত অন্তরগুলো তার অনুগামী হত! (ক্বাছরুল আমাল : ১৪৫: ১৪৫)
হাসান বসরী রহ এর মর্মস্পর্শী কথা
আব্দুল আজিজ ইবন মারহুম রহ. বলেন, আমরা হাসান বসরী রহ.-এর সঙ্গে এক রোগীকে দেখতে গিয়েছিলাম। হাসান বসরী রহ. রোগীকে জিজ্ঞেস করলেন, এখন কেমন অনুভব করছেন?
লোকটি বলল, খেতে মনে চায়, কিন্তু পারি না। তৃষ্ণা লাগে, কিন্তু পানি গিলতে পারি না।
রোগীর কথা শুনে হাসান বসরী রহ. কেঁদে ওঠে বললেন
عَلَى الْأَسْقَامِ وَالْأَمْرَاضِ أُسِّسَتْ هَذِهِ الدَّارُ، فَهَبْكَ تَصِحُّ مِنَ الْأَسْقَامِ، وَتَبْرَأُ مِنَ الْأَمْرَاضِ، هَلْ تَقْدِرُ عَلَى أَنْ تَنْجُوَ مِنَ الْمَوْتِ؟
রোগ-ব্যাধিই হল এই দুনিয়ার মূল ভিত্তি। ধরে নিলাম, রোগ-ব্যাধি থেকে তুমি নিষ্কৃতি পেয়ে গেছ। কিন্তু মৃত্যু থেকে কি নিষ্কৃতি পাবে?
হাসান বসরী রহ. এই মর্মস্পর্শী কথা শোনার পর পুরা ঘরে কান্নার রোল পড়ে যায়। (ইবনু আবিদ্দুনয়া, আযযুহদ : ২৫৭)
আশ্চর্যের বিষয়, মানুষের মৃত্যুকে ভুলে যাওয়া! কীভাবে সে মৃত্যু সম্বন্ধে বেপরোয়া হয়ে থাকে অথচ দিন-রাত তার উপর মৃত্যুর বিভীষিকা ঝুলে আছে!
পরিশেষে দোয়া করি, আল্লাহ আমাদের সকলকে ক্ষমা করে দিন। আজকের কথাগুলো সারা জীবন মনে রেখে এর আলোকে ছোট্ট এই জীবনটাকে পবিত্র ও সুন্দর করার তাওফীক দান করুন। মৃত্যু আঘাত করার পূর্বে তাওবার জীবন গঠন করে মৃত্যুর প্রস্তুতি নেয়ার তাওফীক দান করুন আমীন।
وَآخِرُ دَعْوَانَا اَنِ الْحَمْدُ لِلّهِ رَبِّ الْعَالَمِيْنَ